সারাদেশে শিক্ষকদের নৈতিকতা শেখাবে শিক্ষা অধিদপ্তর

হাওর বার্তা ডেস্কঃ  ইমেজ সংকটে শিক্ষক সমাজের একাংশ। কিছু শিক্ষকের অর্থের লোভে প্রশ্ন ফাঁস, আর্থিক ও যৌন কেলেঙ্কারিসহ নানা অপকর্মে পুরো শিক্ষক সমাজের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। এ অবস্থায় যে শিক্ষকরা যুগ যুগ ধরে জাতিকে নীতি-নৈতিকতা শিখিয়েছেন তাদের নীতি-নৈতিকতা শিখানোর উদ্যোগ নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিক্ষকদের ভাবমূর্তি উদ্ধার করতে এমন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। শিগগিরই দেশব্যাপী এ কার্যক্রম শুরু করবে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)।

বিষয়টি নিশ্চিত করে প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. এসএম ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশে আমরা এ কাজ দ্রুত শুরু করবো। প্রথমে বিভাগওয়ারি শুরু করা হবে। সেখানে শিক্ষামন্ত্রী নিজে উপস্থিত থেকে শিক্ষকদের দিক নির্দেশনা দিবেন। আর জেলা উপজেলা ও প্রশাসন পর্যায়ে কর্মকর্তারা উপস্থিত থেকে শিক্ষকদের নীতি-নৈতিকতা শেখাবেন। তিনি আরো বলেন, শুধু নীতি-নৈতিকতা নয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জঙ্গিবাদ, শিক্ষার মান-পরিবেশসহ আরো অন্যান্য বিষয় শিক্ষকদের আলোকপাত করা হবে। তবে নীতি-নৈতিকতার বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয়া হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলেন, জাতিকে নৈতিকতা শিক্ষা দেয়ার কাণ্ডারি শিক্ষকরা। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ তাদের শ্রদ্ধা করেন। সেই শিক্ষকদের অনেকেই চরম নৈতিকত বিবর্জিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন। অর্থের লোভে প্রশ্নপত্র ফাঁস, জাল সনদে চাকরি নেয়া, কোড পরিবর্তন করে অতিরিক্ত বেতন নেয়া, কোচিং বাণিজ্য, ছাত্রীদের যৌন হয়রানিসহ নানা ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন। এতে করে শিক্ষকতা পেশা ইমেজ সংকটে পড়েছে। তাদের কারণে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এ থেকে উত্তরণে শিক্ষকদের নৈতিক শিক্ষা দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)।

গত ২৪শে এপ্রিল শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ মন্ত্রণালয়ের অধীন সকল উইং, দপ্তর, শাখা ও প্রকল্প প্রধানদের উদ্দেশে অনানুষ্ঠানিক একটি নোট লেখেন। এতে তিনি বলেন, শিক্ষকরা আমাদের মূল শক্তি, নিয়ামক শক্তি। শিক্ষকদের ভূমিকা ছাড়া আমরা কোনো লক্ষ্যই অর্জন করতে পারবো না। কিন্তু দুঃখের বিষয় কিছু অসৎ লোক মহান এই পেশায় ঢুকে পড়েছেন বা অনেকেই আগে থেকে এমন সব অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়েছেন, যার ফলে আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের সম্মানহানি হচ্ছে। এ ধরনের লোককে চিহ্নিত করতে হবে এবং ব্যবস্থা নিতে হবে। শিক্ষকদের মর্যাদা রক্ষার জন্য এটা খুবই জরুরি। এজন্য আমাদের সুনির্দিষ্ট কিছু করণীয় স্থির করতে হবে। তিনি আরো লিখেন, শিক্ষকদের নৈতিক মূল্যবোধ একটি মৌলিক বিষয়। এই বিষয়টি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এ বিষয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে  পরামর্শ করে কর্মসূচি নিতে হবে। সব ধরনের শিক্ষক প্রশিক্ষণে নৈতিক বিষয় হিসেবে যুক্ত করতে হবে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে বিজিপ্রেসসহ সকল ফাঁকফোকর বন্ধ করা হয়। তারপরও এবারের এসএসসি, এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় কয়েকটি বিষয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন শিক্ষকরা। তারা ট্রেজারি থেকে প্রশ্ন পরীক্ষার কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার সময় মোবাইল ফোনে ছবি তুলে ফাঁস করেন। চলতি বছর ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের এসএসসির গণিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে গণ-মাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর অভিযানে নামে গোয়েন্দা পুলিশ। তারা অভিযান চালিয়ে রাজধানীর কমলাপুর শেরেবাংলা রেলওয়ে উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল আলিম, একই স্কুলের ইংরেজি বিষয়ক শিক্ষক মো. রফিকুল ইসলামসহ তাদের সহযোগী ১৬ জনকে আটক করে।

গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য অনুয়ায়ী, ট্রেজারি থেকে পরীক্ষা কেন্দ্রে যাওয়ার সময় তারা প্রশ্ন ফাঁস করেন। ফাঁসকারীরা মূলত নিজেদের কোচিং সেন্টারের সুনাম বাড়াতে এবং নতুন শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ করতে প্রশ্নপত্র ফাঁস করেন। শিক্ষক রফিকুল ইসলাম জ্ঞানকোষ নামে একটি কোচিং সেন্টার পরিচালনা করেন। পরীক্ষার দিন রফিকুল ইসলাম তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী জহিরুলকে প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করতে পাঠান। জহিরুল ট্রেজারি থেকে পরীক্ষার কেন্দ্রে প্রশ্ন নেয়ার সময় ছবি তুলে তা ১০ মিনিটের মধ্যে সমাধান করে নিজেদের ফেসবুকের আইডির লিংকগুলোতে ছড়িয়ে দেন। যারা ওই লিংকে সংযুক্ত থাকেন তারা আগে থেকেই বিকাশ অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে এক থেকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে লিংকগুলোতে যুক্ত হন। প্রশ্নপত্র ফাঁসের জন্য শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ শিক্ষকদের দায়ী করে আসছেন। তাদের নৈতিকতা নিয়েও বিভিন্ন সভা-সেমিনারে প্রশ্ন তুলছেন।

শুধু প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গেই শিক্ষকরা জড়িত নন, সম্প্রতি ভোলার লালমোহন উপজেলার সাতানী বদিউজ্জামান নিম্ন মাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষকের প্রাপ্যতা না থাকার পরও প্রধান শিক্ষক নিজের শালিকাকে নিয়োগ দেন। প্রাপ্যতা না থাকায় এমপিওভুক্তির আবেদন বাতিল হয়ে যায়। এরপর ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে এমপিওভুক্ত হয়েছেন রেহনুর বেগম নামে ওই শিক্ষক। পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ) জালিয়াতির প্রমাণ পেয়েছে। প্রতিকার চেয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) আবেদন করেছেন এলাকাবাসী।

রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী প্রধান শিক্ষক আবদুস ছালাম ভুঁইয়া বিএড সনদ দিয়ে পদোন্নতি নিয়েছেন। স্কুলের অভিভাবক ফোরামের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মাউশির তদন্তে তা প্রমাণ পায়। এরপর শিক্ষা মন্ত্রণালয় তাকে চাকরিচ্যুতির নির্দেশ দিলে তিনি সম্প্রতি হাইকোর্টে রিট আবেদন করেছেন। তার মতো ভুয়া সনদে সারা দেশে কয়েক হাজার শিক্ষক চাকরি করছেন। সম্প্রতি ডিআইএ জাল সনদে চাকরি করা ৫৫৬ জন শিক্ষককে চিহ্নিত করেছেন। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করছে।

রংপুর পীরগঞ্জের সহকারী শিক্ষক শহীদুল্লাহ। তার বেতন স্কেল ১০ম গ্রেড। কিন্তু জালিয়াতি মাধ্যমে গত চার বছর ধরে তিনি ৯ম গ্রেডে বেতন তুলছেন। এই সময়ে তিনি প্রায় ছয় লাখ টাকা বেশি বেতন তুলেছেন। ডিআইএ তদন্ত করতে গিয়ে এই জালিয়াতি ধরা পড়েছে। একই ভাবে জালিয়াতির মাধ্যমে গত ১১ বছরে আড়াই হাজার শিক্ষক গ্রেড পরিবর্তন করেছেন। একই ভাবে জালিয়াতির মাধ্যমে ২৬৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্তর পরিবর্তন করে এমপিওভুক্ত করা হয়েছে। এতে করে সরকারের প্রতি বছর গচ্চা যাচ্ছে প্রায় নয় কোটি টাকা।

এসব অনিয়ম ও দুর্নীতি করেই ক্ষান্ত হচ্ছেন না শিক্ষকরা। ক্লাসে পাঠদান না করে নিজেরা খুলে বসেছেন কোচিং সেন্টার। শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রীদের যৌন হয়রানি, অন্যের জমি দখলসহ নানা ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে। এমনকি জঙ্গি কর্মকাণ্ডসহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডেও জড়িয়ে পড়ছেন শিক্ষকরা। এ বাস্তবতায় শিক্ষকদের নৈতিকতা শেখানোর উদ্যোগ নিয়েছে মাউশি।

 

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর